ছিলেন বাংলাদেশের লোকসংগীত জগতের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তার মরমি ও আধ্যাত্মিক গানের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তার জীবন ছিল সাধনা, সংগ্রাম এবং স্রষ্টাপ্রেমের এক অনবদ্য মিশ্রণ।
প্রারম্ভিক জীবন ও শৈশব
১৯৪২ সালের ১২ মার্চ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন খোয়াজ মিয়া। তার বাবার নাম ছিল মৌলভি আজিজুর রহমান এবং মায়ের নাম আছতুরা বিবি। পরিবারে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন থাকলেও, ছোটবেলা থেকেই খোয়াজ মিয়ার মন পড়ে থাকত সুর ও ছন্দের জগতে। পড়াশোনার চেয়ে বাঁশি বাজানো ও গান গাওয়ার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রবল। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন মেলা ও লোকজ অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়াতেন। এই সময়েই তার মধ্যে বাউল দর্শনের প্রতি আগ্রহ জন্মায়।
সঙ্গীত সাধনা ও আধ্যাত্মিক দর্শন
১৯৬২ সালে, কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে, খোয়াজ মিয়া ‘জ্ঞানের সাগর’ খ্যাত প্রখ্যাত মরমি সাধক ফকির দুর্বিন শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরুর সান্নিধ্যে তিনি বাউল গানের গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও দর্শন আয়ত্ত করেন। তার গানে কেবল প্রেম বা বিরহ নয়, বরং মানবতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, এবং ইসলামি ভাববাদের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রীয় বিষয়াবলি যেমন মহাভারত ও রামায়ণের জ্ঞানও ফুটে উঠেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, “মানুষই মন্দির, মানুষের মাঝেই সত্যকে খুঁজতে হয়”। তার গানে সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে এক অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গড়ার আহ্বান ছিল।
জীবিকার প্রয়োজনে তিনি গানচর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করতেন, কিন্তু কখনোই গান লেখা বা গাওয়া থামিয়ে দেননি।
সৃষ্টিকর্ম ও জনপ্রিয়তা
খোয়াজ মিয়া প্রায় হাজারখানেক গান রচনা করেছেন বলে জানা যায়। তার রচিত গানগুলো খ্যাতিমান শিল্পী ডলি সায়ন্তনী, শিমুল খান, আশিক, সাজ্জাদ নূরসহ আরও অনেকের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার কয়েকটি গানের বাণী অ্যালবামের শিরোনাম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। তার লেখা গানের চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে:
- প্রেম স্বর্গীয় (১ম খণ্ড): ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত
- প্রেম স্বর্গীয় (২য় খণ্ড): ১৯৭১ সালে প্রকাশিত
- গীতি-বিচিত্রা: ১৯৯০ সালে প্রকাশিত
- পঞ্চরস: ২০১৪ সালে প্রকাশিত
সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলায় হাবিব ওয়াহিদ ও তাজিকিস্তানের শিল্পী মেহরনিগরি রুস্তমের কণ্ঠে তার কালজয়ী গান “লাগাইয়া পিরিতের ডুরি, আলগা থাকি টানে রে, আমার বন্ধু মহা জাদু জানে” নতুন করে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচিত করে তোলে। গানটি তিনি ১৯৬৮ সালের দিকে আত্ম-অনুসন্ধান করার সময় লিখেছিলেন।
তার অন্যান্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে:
- “আমার ভয় লাগিল মনেরে, ভয় লাগিল মনে”
- “যাইও না যাইও না কন্যাগো”
- “ভুবন-মোহন রূপ তোমারই”
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার
এই নিভৃতচারী মরমি বাউল সাধক দীর্ঘ বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগার পর ২০২৫ সালের ২৬ জুন ৮৩ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বাউল সংগীতজগতে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
জীবদ্দশায় তিনি প্রচারবিমুখ থাকলেও, তার রচিত গানগুলো তাকে অমর করে রেখেছে। তার জীবন দর্শন ও গান নিয়ে সৈয়দা আঁখি হক “খোয়াজ মিয়া: জীবনকথা ও গীতিসমগ্র” নামে একটি বইও লিখেছেন। বাউল খোয়াজ মিয়া তার গানের মাধ্যমে মানবতা ও আধ্যাত্মিকতার যে বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালির হৃদয়ে অনুরণিত হতে থাকবে।


